আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রাণপুরুষ শামসুর রাহমান-এর জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

0
732

প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে শেষ হতে না হতেই বন্দী শিবির থেকে মুক্তি পেয়ে নিজ বাসভূম ছেড়ে কোনো এক বিধ্বস্ত নীলিমায় নিরালোকে দিব্যরথে বসত গড়লেন বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ তথা পঞ্চাশের দশকে বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ নাগরিক কবি হিসেবে খ্যাত শামসুর রাহমান। কলঅলা এক নায়ে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর পাড়াতলীতে যেতে চাওয়া এই কবি জন্মেছিলেন পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে ২৩ অক্টোবর ১৯২৯ সালে। পিতা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মাতা আমেনা খাতুনের ঘর নতুন আলোয় আলোকিত করেছিলেন। শিশু বাচ্চু তথা শামসুর রাহমানের হাতেখড়ির সূচনা ১৯৫৪ সালে ঢাকার পোগোজ স্কুলে। এই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যে সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিত কবি বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি লিখে সুধীমহলে কবি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতার এই মহাতারকা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতাযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁর কবিতাকে করেছে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর কবিতায় মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন, বাংলা কবিতায় আধুনিকতার ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, সমকালকে ধারণ করেছেন এক সদাজাগ্রত সংবেদনশীলতায় এবং আমৃত্যু অপরাহত কাব্যচর্চায় সহাবস্থান ঘটিয়েছেন অন্তর্জীবনের পাশাপাশি দৃশ্য বহির্জীবনের। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর গভীর অনুভূতিজাত মূল্যবোধ, তাঁর কবিতার চরিত্রের সঙ্গে সন্ধি করেছে। নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় নগরজীবনের যন্ত্রণা, একাকিত্ব, পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন তথা নগরজীবনের আদ্যোপান্ত রূপ প্রস্ফুটিত হলেও অনাবিল সৌন্দর্যের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্যও ফুটে উঠেছে প্রায় প্রতিটি কবিতায়।

আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রাণপুরুষ শামসুর রাহমান নেশা হিসেবে কবিতাকে বেঁচে নিলেও জীবন-জীবিকার তাগিদে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। এই পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করার পর কবি যোগ দেন রেডিও পাকিস্তানে। কিন্তু রেডিওতে অনুষ্ঠান প্রযোজনার কাজেও স্বস্তি বোধ করেননি। ফলে ১৯৬০-৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি রেডিওতে কাজ করার পর ১৯৬৪ সালে মর্নিং নিউজে উচ্চতর পদে যোগ দেন। ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে সংবাদপত্রে লেখালেখি করতেন তিনি।

একাত্তরের ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ বিবরণ তিনি লিখে গেছেন আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’ গ্রন্থে ও সব পরোক্ষ বিবরণ বিধৃত আছে এ সময়ের অভিজ্ঞতার ওপর রচিত উপন্যাস ‘অদ্ভুত আঁধার এক’। ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ যুদ্ধকালীন লেখা কবিতাগুচ্ছ মুক্তিযুদ্ধ শেষে ‘বন্দী শিবির থেকে’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফসল অজস্র গল্প, উপন্যাস, কবিতার মধ্যে ‘বন্দী শিবির থেকে’র কবিতাগুলো অনন্য মর্যাদার অধিকারী। একই সঙ্গে অন্তরের রক্তক্ষরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও একাত্মতা, নিজের বন্দিত্বের বেদনা ও অসহায়ত্ব ও মুক্তির স্বপ্ন এ কবিতাগুচ্ছকে দিয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য কাব্যের গৌরব।

অজস্র ধারায় কবিতা রচনার পাশাপাশি শামসুর রাহমান যে অনুবাদ করেছেন সেগুলোও তাঁর সামগ্রিক কবিকর্মের অংশ। অনুবাদগুলোর মধ্যে ইউজিন ও’নীলের ‘মার্কোমিলিয়ানস’ (১৯৬৭), রবার্ট ফ্রস্টের ‘নির্বাচিত কবিতা’ (১৯৬৮), খাজা ফরিদের ‘কবিতা’ (১৯৬৯), টেনেসি উইলিয়ামের ‘হৃদয়ের কবিতা’ (১৯৭১)।

ছড়াকার হিসেবে শামসুর রাহমান নিঃসন্দেহে প্রথম শ্রেণির একজন। তাঁর আটটি ছড়ার বই। এর প্রথমটির প্রকাশকাল ১৯৭৪, শেষটির ২০০৫। একপর্যায়ে বেশ কিছু গান রচনা করেছিলেন তিনি। সাহিত্যরসযোদ্ধা ও সমালোচক শামসুর রাহমানের পরিচয় বিধৃত আছে তাঁর ‘আমৃত্যু তার জীবনানন্দ’ (১৯৮৬) ও ‘কবিতা এক ধরনের আশ্রয়’। ৬৬টি কাব্যগ্রন্থ, চারটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধগ্রন্থ, আটটি ছড়ার বই, ছয়টি অনুবাদসহ একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের এই প্রণেতা কাব্যসাধনাকালেই অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন। তার মধ্যে আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। লোকোত্তর এই মহাসাধক কবি ১৭ আগস্ট ২০০৬ সালে ইহজাগতিক সব সম্পর্ক ছিন্ন করে পাড়ি জমান অন্য জগতে। তবু তিনি আছেন। তিনি থাকবেন। লুব্ধক তারা হয়ে পাঠকের মনের আকাশে থেকে যাবেন যুগ থেকে যুগান্তরে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here