চার মিয়ানমার সেনার স্বীকারোক্তি ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

0
544

তিন বছর আগে ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যখন অভিযান শুরু করেছিল সেদেশের সেনাবাহিনী, তখন এক সেনা কর্মকর্তা তার অধীনস্থ জওয়ানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে- ‘যা দেখবে, যা শুনবে, সব লক্ষ করেই গুলি চালাবে।’ আরেক সেনা কর্মকর্তার নির্দেশ ছিল- ‘যাকে পাবে তাকেই গুলি করবে।’ সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাবেক চার সদস্য জ নাইং তুন, মায়ো উইন তুন, চ্যাও মিও অং এবং পার তাও নি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এ ধরনের স্বীকারোক্তি দিয়েছে। স্বীকারোক্তি দেয়ার ভিডিও ফুটেজ নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে এসেছে এবং তা তারা প্রকাশ করেছে। অনেকগুলো সংবাদমাধ্যমে এ খবর বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত হয়েছে।

এ ধরনের স্বীকারোক্তি অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এলো। এক. এ স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে মিয়ানমারের রাখাইনে সেদেশের সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিল এবং পরিকল্পিতভাবে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করেছিল। দুই. একজন স্থানীয় সেনা কমান্ডার এ ধরনের ‘বড়’ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এর সঙ্গে শীর্ষ সেনা কমান্ডার তথা সেনাপ্রধান জড়িত। তিন. মিয়ানমারের রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোয় শীর্ষ ব্যক্তি হচ্ছেন অং সান সু চি। এ ধরনের উচ্ছেদ অভিযান তার সম্মতি ছাড়া সম্পন্ন হয়েছে, এটা স্বীকার করে নেয়া যায় না। যে অভিযোগে এখন এই চার সেনা সদস্য অভিযুক্ত হবেন, সেই একই অভিযোগে সু চিও অভিযুক্ত হবেন। চার. হঠাৎ করেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করেনি। একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই রোহিঙ্গাদের সেখান থেকে উৎখাত করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক ‘বড় শক্তিগুলোর’ পরোক্ষ সমর্থন ছিল।

পাঁচ. আগামী নভেম্বরে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন। রাখাইনে নির্বাচন হচ্ছে না। এবং কোনো মুসলমান প্রার্থীকে সেখানে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে, মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব মিয়ানমার সরকার আবারও প্রমাণ করল। ছয়. সর্বশেষ আসিয়ান মন্ত্রিপরিষদের ভার্চুয়াল সম্মেলনেও (৯ সেপ্টেম্বর, হ্যানয়) রোহিঙ্গা ইস্যু অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ‘বড় কর্মসূচি’ নিতে পারেনি আসিয়ান। সাত. জানুয়ারি মাসে (২০২০) আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রক্ষার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার আদালতের সেই নির্দেশ মানছে বলে মনে হয় না। কারণ গত ৪ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের জনপ্রিয় দৈনিক Irrawaddy-এর এক সংবাদে বলা হয়েছে, Rathedaung টাউনশিপের একটি গ্রাম Kyauktan, যেখানে এখনও কিছু রোহিঙ্গা বাস করেন, সেখানে বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই গ্রামে বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ করেছে বলে Burma News International আমাদের জানিয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশও মানছে না। এখনও যেসব রোহিঙ্গা পরিবার রাখাইনে আছে, তাদেরও উচ্ছেদ করা হচ্ছে- এর বড় প্রমাণ প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ দ্বীপপুঞ্জে আশ্রয় গ্রহণ। chron.com আমাদের এ সংবাদটি দিয়েছে। ওই রোহিঙ্গারা রাখাইন থেকে উচ্ছেদ হয়ে সমুদ্রপথে আচেহ প্রদেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

এই যখন পরিস্থিতি তখন করোনাভাইরাস মহামারী সত্ত্বেও মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি করেছিল। এ মহামারীর মধ্যেও অং সান সু চি নির্বাচন করতে চান এবং সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে আরেকবার ক্ষমতায় যেতে চান। সেনাবাহিনীও গোষ্ঠী স্বার্থে সু চিকে ব্যবহার করছে। স্মরণ করা যেতে পারে, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সু চি সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। সারা বিশ্ব যেখানে রাখাইনের গণহত্যার কথা বলছে, সেখানে সু চি গণহত্যাকে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি শীর্ষ জেনারেলদের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। তিনি জেনারেলদের ‘সন্তুষ্ট’ রেখে আরেকবার ক্ষমতায় যেতে পারবেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার তার ‘স্বপ্ন’ কোনোদিনই পূরণ হবে না। সংবিধান এখানে বড় বাধা। সেনাবাহিনী কোনোদিনই তাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দেখতে চাইবে না। বর্তমান প্রেসিডেন্ট উইন মাইইন্ট (Win Myint) ২০১৮ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তার টার্ম শেষ হবে ২০২৩ সালে। তবে অতি ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী প্রধান মিন আউং হ্লায়াইংয়ের দৃষ্টি প্রেসিডেন্ট পদটির দিকে। ২০১১ সাল থেকেই তিনি সেনাবাহিনী প্রধান। তার অবসরের সময় হয়েছে। নভেম্বরের নির্বাচনের পর জানুয়ারিতে সংসদ গঠিত হবে। নতুন সরকারে জেনারেল হ্লায়াইংয়ের ‘পদ’ কী হবে, কিংবা প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাপারে তিনি তার মনোবাসনা পূরণ করতে পারবেন কিনা, সেটাই দেখার বিষয়।

কিন্তু উচ্ছেদকৃত রোহিঙ্গাদের কী হবে? তারা কি যুগের পর যুগ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করবে, যেমনটি করেছিল ফিলিস্তিনিরা তাদের নিজস্ব বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে। আমরা বলেছিলাম, রোহিঙ্গারা হতে যাচ্ছে ‘দক্ষিণ এশিয়ার ফিলিস্তিনি’ নাগরিক। বাড়ি নেই, ঘর নেই- এক অনির্দিষ্ট জীবন! বিশ্ব সম্প্রদায় কিংবা আঞ্চলিক শক্তিগুলো কি তাই চাচ্ছে? আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা কিংবা চার সেনা সদস্যের স্বীকারোক্তি রোহিঙ্গাদের জন্য আদৌ কোনো আশার বাণী নয়। পশ্চিমা শক্তিগুলো রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আগের মতোই উদাসীন। বরং সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তারা মিয়ানমারে, বিশেষ করে রাখাইন অঞ্চলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত করেছে। বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। যেখানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান কক্সবাজার এলাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে, সেখানে চীন, ভারতসহ অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশগুলো বিশাল পুঁজি বিনিয়োগ করছে মিয়ানমারে। তাদের দরকার ব্যবসা। এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য দেই। ১. ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ অর্থ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। অক্টোবর (২০১৯) থেকে সেপ্টেম্বর (২০২০) পর্যন্ত ২৩৪টি ‘ফরেন ইনভেস্টমেন্ট’ রেকর্ড হয়েছে সেখানে (মিয়ানমার টাইমস, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)। ২. রেঙ্গুনে নতুন একটি শিল্পপার্ক গড়ে তুলছে জার্মান ফার্ম রোলান্ড বার্জার। এখানে অর্থের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এ অর্থের বিনিময়ে জার্মান ফার্মটি তৈরি করবে ব্রিজ, সড়ক এবং ১০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে একটি শিল্পপার্ক (দৈনিক ইরাওয়াদ্দি, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০)। ৩. গত ১০ মাসে মিয়ানমারে পাওয়ার সেক্টরে বিনিয়োগ এসেছে ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার (মিজ্জিমা নিউজ, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০)। ৪. ফিলিপাইনের ঝিকল্যাব ডিজিটাল কোম্পানি মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। ৫. শ্রীলংকা মিয়ানমারের ট্যুরিজম সেক্টরে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখিয়েছে।

আমি আমার একাধিক লেখায় বলার চেষ্টা করেছি যে, মিয়ানমারে চীনা স্বার্থ সবচেয়ে বেশি। ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চীন মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে ২০.২৪ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় মিয়ানমারে যত বিনিয়োগ এসেছে, তার মধ্যে চীনের বিনিয়োগ ছিল সবচেয়ে বেশি। চীন মিয়ানমারের পাওয়ার সেক্টরে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে। মোট বিনিয়োগের শতকরা ৫৭ ভাগ এই সেক্টরে করা হয়েছে। এর পরের অবস্থান তেল ও গ্যাস সেক্টরে, বিনিয়োগের পরিমাণ শতকরা হিসাবে ১৮ ভাগ।

মিয়ানমার চীনের সীমান্তবর্তী দেশ। এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বন্ধনটা ঐতিহাসিক। একজন গবেষক ও লেখক মাউং আউং মাইও (Maung Aung Myoe) চীন-মিয়ানমার সম্পর্ককে উল্লেখ করেছেন ‘Pauk-Phaw’ হিসেবে। ‘Pauk-Phaw’ বার্মিজ শব্দ। এর মধ্য দিয়ে জাতিগতভাবে দু’দেশের মাঝে যে মিল আছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। দু’দেশের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে বার্মিজ নেতারা অতীতেও এ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীনের ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ মেটানোর স্বার্থে দেশটি ভারত মহাসাগরে নির্বিঘ্নে তার জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে কিয়াউক পিউতে (রাখাইন রাজ্য) সমুদ্রবন্দরটি চীন নির্মাণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মিয়ানমার একটি অংশ। খুব সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি চীনের কাছে প্রধান্য পায়নি কখনও। এক সময় চীন একটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কোনো জট খোলেনি।

সম্প্রতি চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ইয়াং জাইসি (Yang Jiechi) মিয়ানমার সফর করে গেছেন। তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটিক্যাল ব্যুরোর সদস্য। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীনা প্রেসিডেন্টের ঐতিহাসিক সফরের পর (জানুয়ারি ২০২০) একজন শীর্ষ চীনা নেতা মিয়ানমার সফর করে গেলেন। এর মধ্য দিয়ে চীন মিয়ানমারের প্রতি তাদের সমর্থন আবারও পুনর্ব্যক্ত করল (দি স্টার, ৬ সেপ্টেম্বর)। চীনের স্বার্থ আছে মিয়ানমারে। এটা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে জাপানের এশিয়া টাইমস গত ৩ সেপ্টেম্বর। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘Why China wants Suu Kyi to win Myanmar’s polls’- কেন চীন চাচ্ছে সু চি নির্বাচনে বিজয়ী হোন।

পরিস্থিতি সম্ভবত সেদিকেই যাচ্ছে। একদিকে কোভিড-১৯, মিয়ানমারের অনেক অঞ্চলে এ মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে; অন্যদিকে দেশটিতে শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল না থাকা, এবং মুসলমান প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশ নিতে না দেয়া- সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আদৌ কোনো ভালো খবর নেই। চারজন সাবেক সৈনিকের হেগের আদালতে আত্মসমর্পণ ও স্বীকারোক্তি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করি না।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here