রুবেল সাইদুল আলম এর ‘ভবঘুরে অভিলাষ’: প্রেমের কাব্যগ্রন্থ

0
53

বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কবির জন্ম হচ্ছে, বিস্তৃত হচ্ছে আমাদের সাহিত্যাঙ্গন। নতুন অনেকের সাথেই পরিচয় ঘটলেও সঙ্গত কারণেই কারো কারো কবিতা পাঠের আগ্রহ জন্মেনা। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রুবেল সাইদুল আলম। আমাকে আমার পরম শ্রদ্ধেয় বড়ভাই, দেশের মিডিয়া ও কর্পোরেট জগতের আইকনিক ব্যক্তিত্ব উদয় হাকিম ভাইয়া তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ ‘ভবঘুরে অভিলাষ’ পড়ার জন্য দিলে আমি শুধু পাতা উল্টাতে পরিনি কবিতাগুলো পড়তে হয়েছে। অর্থাৎ ‘কবিতা’ আমাকে পড়ার জন্য রীতিমতো আগ্রহান্বিত হতে বাধ্য করেছে। তার মানে রুবেল সাইদুল আলম নি:সন্দেহে কবিতা বুঝেন এবং কবিতার ক্ষেত্রটিকে সযত্নে লালন করতে জানেন। সূচিপত্র অনুযায়ী এই কাব্যগ্রন্থে মোট ৮৫টি কবিতা রয়েছে। এর মধ্যে গ্রন্থ নামের কবিতাটি দিয়েই শুরু। মুক্ত পদ্যের কবিতায় যে ছন্দের দোলায়িত বাতাসে পর্দা দুলে ওঠে ভবঘুরে অভিলাষ
কবিতায় তার সেই উদাহরণ স্পষ্ট। কবি যখন লেখেন-
‘আমি চাই অলস সন্ধ্যায় কিংবা রাতে
কেউ শুধু আমার জন্য
চোখে একটু কাজল দিক, একটু মিষ্টি করে হাসুক,
আমি দেখি কিংবা না দেখি।
রাতে ঘুমানোর আগে মানুষটা অন্তত একবার বলুক:
ঘুমাতে গেলাম, ভালোবাসি, ভালো থেকো।
অথবা
আমি চাই না কেউ তার সব ব্যস্ততা শেষ করে
অলস সময় আমার জন্য বরাদ্দ রাখুক।
সেলুলার ফোনের স্ক্রীনে নিয়ম রাখার জন্য আঙুল চালাক।
‘বিসর্জিত অর্ঘ্য’ কবিতায় কি সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন-
‘তোমাদের শহরেও কি চাঁদের হাসিতে
প্রেমিক প্রেমিকারা রাস্তায় নেমেছে?

টং দোকানে চা খাচ্ছে কিংবা সিগারেট ঠোঁটে
নিয়ে উন্মাতাল সুরে ভাসছে?
নাকি… হৃদয়ের কালো মেগে ঢাকা পড়েছে চাঁদের অহংকার?
আমিতো আয়েশ করে বরই কাঠের বেঞ্চিতে বসে জোছনা পান করছি
হৃদয়-বেলুনে শুষে নিচ্ছি জোছনা,
যতটা পারা যায়।…’
এ যেন সেই রবীন্দ্রনাথের আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে- স্মরণ করিয়ে দেয়। কবির কবিতার ভাষা খুবই সহজ। কোনো দুর্বোধ্যতা নেই। সবাই পড়তে ও বুঝতে পারে। এটা হচ্ছে পাঠকের সাথে যোগসূত্র তৈরির অন্যতম মাধ্যম। তার কবিতা বোদ্ধা কবিদের জন্য নয়,একদম সাধারণ মানুষের জন্য। রুবেল সাইদুল আলম একজন দক্ষ প্রেমের কবি। তার এই বইটিতেও তার অসংখ্য উদাহরণ তিনি রেখেছেন। তিনি যখন লেখেন- স্নান শেষে তোমার মুখে নাকে জমে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জলে এখনো কি ভালোবাসা আর সময় জমে থাকে?
নাকি তুমি কারো কাছে এখন শুধুই একজন নারী?
মায়াবতীর কাছে খোলা চিঠি’র এই কবিতায় কবি তার প্রেমিকার এই দৃশ্যকল্প তুলে ধরে যে
কোনো প্রেমিক মানসকেই উপস্থাপন করছেন।
‘সরাইখানার সুন্দরী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
জোনাকির শিশ্নলিঙ্গের আলো আমি
গোপন করে রাখি দু’আঙুলের ভাঁজে
বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী ঘষে
যে কোনো সময় বের করতে পারি টেক্কার ট্রয়,
করতল বিছিয়ে বের করে দিতে পারি
রঙের ট্রামকার্ড, চিৎকার আর হুল্লোড়ে
মাত করে দিতে পারি জুয়াড়ির টেবিল’
অথবা

বেলি ফুলের খোঁপায় চুম্বনের চাদর মুড়িয়ে
বুকের বাতাসে বেলুন ফুলাই
মন ফাগুনের ক্যানভাসে,
নিয়ন গ্যাসে ফানুস ওড়াই
অমোঘ ক্যাস্পিয়ান সাগরের তীরে’
এই কবিতায় এক ধরনের চিত্রকল্প আছে। চোখ ভাসে তাস খেলার মুহূর্তে টেক্কার আনন্দ উল­াস।
করোনা ও ক্ষয়িষ্ণু মানবতা- এই কাব্যগ্রন্থের একটি উলে­খযোগ্য কবিতা। এই কবিতাটিতে যাপিত
জীবনের নিত্য নৈমিত্তিক চরিত্রগুলো উঠে এসেছে। বিশেষ করে করোনার সেই বিভীষিকাময়
দিনগুলোর যে চিত্র মানুষ দেখেছে তা তার কবিতায় চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। এক করোনা
আক্রান্ত পিতার করুণ হাহাকার এভাবেই তুলে এনেছেন কবি-
‘একটু আস্তে তুলো বাবা
কোমরটায় বেশ কিছুদিন হলো
বেশি ব্যথা হচ্ছে…
কোথায় ফেলছ আমায়?
না না… এই বড় ডাস্টবিনে ফেলো না
ওই রাস্তার ধারের ফুটপাতে রেখে যাও
তাহলে হয়তো পুলিশ টুলিশ
কেউ দেখতে পাবে…
একটা গোর কিংবা সৎকার পাব।
নয়তো কুকুর ছিঁড়ে খাবে, কারণ-
কুকুরগুলোও এখন খাদ্যবিহীন
অনলে পুড়ছে।

তোমাদের প্রতি আমার আশীর্বাদ
মৃত্যুকালে তোমরা যেন প্রিয়জনের চোখের জল দেখতে পাও।
আরেকটা কথা, শুনে যাও…

একটু দাঁড়াও
তোমাদের মা কিন্তু অসুস্থ নয়,
তোমরা তাঁকে জঙ্গলে ফেলে এসো না
দোহাই তোমাদের…।
মূলত: করোনা ভাইরাসের মহা সঙ্কটকালে এ ধরনের চিত্র ছিল খুব স্বাভাবিক। করোনা আক্রান্ত পরিবারের আপন স্বজনও হয়ে যেতো পর। তাদের প্রতি এরকম আচরণের ঘটনা অসংখ্য ঘটেছে। যাযাবর ভালোবাসা কবিতায় তার উদাহরণ সপ্রতিভ-
‘যতবার তোমাকে ভালোবেসে সমুদ্রের প্রতি
ছুড়ে দিই এক গভীর চুম্বন,
ততবার তুমি প্রবল তৃষ্ণা হয়ে
ফিরে আসো এই ঠোঁটে।’
কবির এই কবিতায় এই ক’লাইনে এক ধরনের কাব্যিকতা আছে, আছে কবিতাও। কবিকে উপলব্ধি করতে হবে কবিতা একটা পথভ্রমণ। কবিকে শুধু সহজ ভাষায় দৃশ্য তুলে ধরলেই হবে না, তার ছত্রে ছত্রে থাকতে হবে কাব্যিকতা। তা না হলে তা নিরেট গদ্যে পরিণত হবে। রুবেল সাইদুল আলম এর মধ্যে কবিত্ব আছে, দেখার চোখ আছে- বিশেষ করে তিনি একজন
প্রেমিক কবি। তবে তার কবিতায় কাব্যিক দ্যোতনার অভাব আছে, ছন্দের অভাব আছে। দক্ষতার সাথে এ বিষয়গুলো উপস্থাপিত করতে পারলে তিনি কবিতার পথভ্রমণে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছতে পারবেন তা নিশ্চিত বলা যায়। তার প্রতিটি কবিতাই পাঠকের ভালো লাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তার কাব্যজীবনের দীর্ঘায়ু কামনা করি।

বইটির ছাপা ও বাঁধাই চমৎকার।
বইটির প্রকাশক : স্বদেশ শৈলী। মূল্য ৩০০ টাকা।

© হাফিজ রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here